• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

আরো সংকটে পড়তে পারে জ্বালানি খাত

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০২১

বিশ্ববাজারে তেল, গ্যাস ও কয়লা সংকটের পাশাপাশি পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে জ্বালানির এসব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। করোনা মহামারির শুরুর পর থেকে গত দেড় বছরে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। প্রায় প্রতি মাসেই আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের দর বাড়ছে। বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক ওয়েবসাইট ‘ট্রেডিং ইকোনমিকস’-এর হিসাব অনুযায়ী ২০ অক্টোবর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বা ক্রুড অয়েলের দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৩ দশমিক ৭৬ ডলার, যা ২৮ অক্টোবর থেকে বেড়েছে ১ দশমিক ২৬ ডলার বা ১ দশমিক ৫৩ ভাগ বেশি। এ ছাড়া ট্রেন্ড ইকোনমিকসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ ডিসেম্বর প্রতি টন কয়লার দাম ৭২ ডলার হলেও বর্তমানে দাম ১৫০ ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম ১০৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়, ইট এবং সিমেন্টের মতো অতি প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম এখন রেকর্ড সর্বোচ্চ। মূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে নিয়ন্ত্রিতভাবে পণ্যটি আমদানি করছে সরকার। প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট) এলএনজির দাম পড়েছে প্রায় ৩২ ডলার করে। এর আগ পর্যন্ত এত দাম দিয়ে এলএনজি কেনার রেকর্ড নেই বাংলাদেশের।

এ অবস্থায় চাপে পড়েছে দেশের জ্বালানি বিভাগ। কেবল জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এরই মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন প্রায় ২১ কোটি টাকা। করোনা প্রকোপ কমে আসায় বিশ্বজুড়ে জ্বালানির ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের এ টালমাটাল পরিস্থিতিতে শঙ্কিত হয়ে উঠছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জ্বালানি পণ্যের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এসব পণ্যের ক্রমাগত দরবৃদ্ধি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেই বড় ধরনের আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ঊর্ধ্বগতি কোভিড-পরবর্তী উত্তরণ পর্বকে ক্রমেই হুমকির মুখে  ঠেলে দিচ্ছে জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি। সবমিলিয়ে দেশের জ্বালানি খাতে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমরা বর্তমানে একটা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি। একদিকে, আমাদের নিজস্ব জ্বালানির সঙ্কট অন্যদিকে, আমদানিকৃত জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী। সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচের ওপর চাপ পড়ছে। আমাদের নিজস্ব গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় আমরা দ্বিমুখী সংকটে পড়ছি। কয়লার অবস্থাও একই। আমাদের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে চায়নিজদের সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ায় নতুন করে কন্ট্রাকে যেতে হচ্ছে। ফলে এখানেও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এলএনজির দাম বেড়েছে ৫ গুণ। সবমিলিয়ে আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছি।’

বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টাকে ভোলাটাইল (অস্থির) উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ সেক্টর যেহেতু তেল, গ্যাস এবং কয়লার ওপর নির্ভরশীল ফলে এটির প্রভাব সব সেক্টরেই পড়বে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিই আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণের প্রথম উপায়। এজন্য সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। দ্বিতীয়ত, আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, যদিও সেটিও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।’  

এদিকে, কয়লার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় নির্মাণ সামগ্রীর দাম আরও বাড়বে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণে স্থবিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। উৎপাদন খরচ বাড়ার শঙ্কায় ইটভাটা মালিক সমিতি গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ইট পোড়ানো বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিলো। স্থানীয় পর্যায়ে কয়লার দাম কমাতে সরকারকে কয়লা আমদানিতে শুল্ক কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও ইটভাটা, সিমেন্ট ও বেশ কিছু চা কারখানার প্রধান জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহূত হয়। দেশে কয়লার বাজারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টন।

বাংলাদেশ কয়লা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সৈয়দ মো. আতিকুল হাসান বলেন, চীনসহ কয়েকটি দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কয়লার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি টন কয়লা ৫৫ থেকে ৬৬ ডলারে আমদানি করতাম। বর্তমানে তা ১৫০ ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। ক্রেতারা এই দামে কিনতে পারলে আমরা সরবরাহ করতে প্রস্তুত।’

এদিকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইট পোড়ানো শুরু করলেও কয়লার দাম বাড়ায় চলতি বছর এখনও তিনি উৎপাদন শুরু হয়নি বেশিরভাগ ইটভাটায়। জানা গেছে, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলার প্রায় সাত হাজার ইটভাটায় একই অবস্থা বিরাজমান। অগ্রিম অর্থ নিয়েও প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ ছাড়াই দিন অতিবাহিত করছেন।

কয়লার দাম বৃদ্ধির ফলে সিমেন্ট উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেকচারারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, দেশে প্রতি মাসে সিমেন্টের চাহিদা চার কোটি টন। গত চার মাসে শিপিং খরচসহ প্রতিটন ক্লিঙ্কার এবং অন্যান্য কাঁচামালের দাম ২০ ডলার বেড়েছে। প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট উৎপাদনে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন ৪০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। একইভাবে, কয়লা ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়েছে চা উৎপাদনেও। সিলেটে চা উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহূত হলেও চট্টগ্রাম এবং পঞ্চগড়ে চা উৎপাদনে কয়লা ব্যবহূত হয়।

চট্টগ্রামের বারমাসিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক এবাদুল হক বলেন, পাঁচ মাসে এক কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ১৮০ টাকা হলেও এখন তা ২০০ টাকায় গিয়ে পৌঁছানোয় চা বাগানে টেকসই উৎপাদন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে, জ্বালানি সংকট এবং দাম প্রভাব ফেলবে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর। সংকটের সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবহেলাকেও দায়ী করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকার যদি অনেক আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরে তেল, গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতো তাহলে বর্তমান সংকট থেকে অনেকটাই রেহাই মিলত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads